আলো নয়, আলেয়া

এ ক’দিনে কমলার রূপের খ্যাতি মিঠেখালি গ্রামের গণ্ডি ছাড়িয়েছে, সেটা এক রকম জানাই ছিল। কিন্তু সে খ্যাতি যে এত দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে তা ধারণা করেননি শরীফ মাতব্বর নিজেও।
আষাঢ় মাসে কাঁঠাল পাকে। বাতাসে ছড়ায় তার গন্ধ। গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে দশ দিক থেকে ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে আসে মাছিরা। দলে দলে। ঝাঁকে ঝাঁকে। ভনভন করে পাকা কাঁঠালের চারিপাশে। নাচগান করা মেয়েমানুষের রূপ জিনিসটাও অনেকটা একই রকমের। সে রূপের খ্যাতি ছড়ায় বাতাসে- কাঁঠালের মন উচাটন করা গন্ধের মতো, টেনে আনে পুরুষের ঝাঁক। দূর-দূরান্ত থেকে। পুরুষগুলো ভনভন করে তার চারিপাশে। তখন পুরুষে আর মাছিতে খুব বেশি তফাৎ থাকে না।
মিঠেখালি গ্রামে ঢোকার মুখে খানিকটা খোলা জায়গা। সেখানে বড় প্যাণ্ডেল করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহ প্রতিরাতে চলছে সেখানে পুতুলনাচ। প্যাণ্ডেলের মধ্যে দক্ষিণপাশে একটা ছোট মঞ্চ করা হয়েছে। তার একপাশে তোলা হয়েছে দু’টো অস্থায়ী ঘর। ওখানে থাকে পুতুলনাচদলের জনা আষ্টেক সদস্য। কমলা ওদেরই একজন। অবশ্য কমলা ছাড়াও আর একটা মেয়ে রয়েছে এই দলে। কিন্তু রূপের বিচারে সে মেয়েটি যেন কমলার বা’ হাতের কড়ে আঙুলের ছোট্ট নখটারও যোগ্য নয়। তাই তাকে নিয়ে মাতামাতিও নেই অতটা।
পুতুলনাচের আসরে এখন আর পুতুল নাচে না। তার বদলে নাচে যুবতী মেয়েরা। শরীফ মাতব্বর জানেন, মানুষ এখন আর পুতুলনাচ দেখতে আসেও না। তারা আসে সংক্ষিপ্ত পোষাক পরা নারী-শরীরের ফণা তোলা দেখতে, তার ছোবল খেতে, বিষে নীল হতে। গতকাল দেখা গেল সাড়ে ছয় কিলোমিটার দূরের বারিষপুর বাজারের মনোহারি ব্যবসায়ী কুদ্দুস মিয়া মাঘের শীতকে উপেক্ষা করে সন্ধ্যেয় সন্ধ্যেয় এসে হাজির পুতুলনাচের প্যাণ্ডেলে। তার মতো আরও অনেকে আসছে। প্রতিরাতে, আশপাশের দশগ্রাম থেকে। তারা আসছে কমলার রূপের সাক্ষী হতে। কমলার নাচে মন ভিজাতে। গন্ধে মাতোয়ারা ভনভনে মাছির মতো দশা তাদের।
গর্বে বুক ভরে ওঠে শরীফ মাতব্বরের। তিনি গ্রামের মেম্বর নন, নন এলাকার চেয়ারম্যানও। তারপরও গ্রামের মাথা তিনি। অগাধ অর্থ-বৈভব তার শক্তি। যে শক্তির কাছে মাথা নত করে গ্রামের মানুষ, গ্রামের মেম্বর। চেয়ারম্যান সাহেবও এ এলাকায় এলে তার সাথে দেখা না করে যান না। গ্রামে পুতুলনাচের আসর বসানো নিয়ে অনেকের আপত্তি ছিল। তিনি কারো আপত্তি গায়ে মাখেন নি। প্রায় সম্পূর্ণ একক চেষ্টায় আয়োজন করেছেন এই পুতুলনাচ। মানুষ মন ভরে উপভোগ করছে তার আয়োজন। তার আয়োজন সার্থক হয়েছে। দশগ্রামের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিই তার প্রমাণ। তবে একটা ব্যাপার তিনি ঠিক মানতে পারছেন না। সেটা হচ্ছে, এই কুদ্দুস মিয়ার মতো কিছু চালচুলোহীন লোকের কারণে-অকারণে কমলার কাছে ঘেঁষা। এ ক’দিনে প্রচ্ছন্ন একটা অধিকারবোধ জন্মেছে এই পুতুলনাচদলটার উপর। কমলার উপরে তো বটেই!
 রাতের খাবার খেয়ে নিলেন শরীফ মাতব্বর, একটু আগেভাগেই। ক’দিন ধরে শীতটা পড়ছে বেশ। কাশ্মিরী শালটা গায়ে জড়ালেন, মাফলার পেঁচালেন গলায়। পাঁচ ব্যাটারীর টর্চলাইটটা হাতে নিলেন, দেয়ালে আলো ফেলে দেখলেন কোন ছায়া আছে কি না। গলা তুলে ডাকলেন, ‘কি রে মতি, আছস?’
অনতিদূর থেকে একটা গলা ভেসে এলো, ‘আচি ভাইসাব।’
‘দাঁড়া, আইতাছি।’ বললেন মাতব্বর। তারপর মুখ ঘুরালেন ভিতরবাড়ির দিকে, রাগী গলায় বললেন, ‘ছোড বউ, আমার পান দিলা না? দেখতেছো না, আমার দেরি হইতেছে?’
একটু বাদে দরজার আধখোলা পাল্লাটা সরিয়ে ঘরে ঢুকল বড় বউ, হাতে পানের খিলি। তাকে দেখেই মেজাজ তিরিক্ষি হলো শরীফ মাতব্বরের, ‘তোমারে আইতে কইছে কেডা? বললাম না ছোড বউরে পান নিয়া আইতে!’
‘তার শরীলডা ভালা না। হুইয়া রইছে।’ বললো বড় বউ।
‘তোমাগো শরীল কবে ভালা থাকে হুনি?’ মাতব্বরের কণ্ঠে ঝাঁঝ, পানের খিলি মুখে দিলেন।
‘হ, আমাগো শরীল তো ভালা থাকে না। তাইলে কি আর করা! ভালা শরীল-গতর দেইখ্যা আর একটা বিয়া করেন।’ দপ করে জ্বলে উঠল বড় বউ।
‘হ, তাই করন লাগব দেখতাছি।’ পান চিবোতে চিবোতে বললেন মাতব্বর।
‘হ, কইরা ফালান। আপনারে আটকাইতেছে কেডা? যাইতেছেন তো কমলার ঢলানি দেকতে। ব্যাবাক মাইনষে কয় তার চেয়ারা ভালা। গায়ে-গতরেও শুনি মাশাল্লা। তার উপর ভালা নাচ-গান জানে। তারে বিয়া করলেই পারেন। আমাগো দিয়া তো আপনার চলে না।' খেঁকিয়ে উঠল বড় বউ।
‘তোগো দিয়া আমার ক্যামনে চলে? কি দিছত তোরা আমারে? একটা সন্তান দিছত? দিতে পারছত? পনের বছর ধইরা পালতাছি তরে। ছোডডারে পালতাছি দশ বছর। সাদা গাইগরুডা এই পনর বছরে কয়ডা বাছুর দিছে গুনছত কোনদিন?’ বড় বউয়ের হাত ধরে জোরে একটা ঝাঁকুনি দিলেন মাতব্বর।
‘ছাড়ো। আমার হাত ছাড়ো। যে তোমারে সন্তান দিতে পারব, হ্যার কাচেই যাও।’ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো বড় বউ, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
‘হ, তাই যাই।’ বললেন মাতব্বর। কায়মনোঃবাক্যে চেষ্টা করলেন শান্ত থাকতে। মনটাকে প্রশান্ত রাখা বড় প্রয়োজন। মনে প্রশান্তি না থাকলে উপভোগ জমে না।
বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর এগিয়ে মাতব্বর গলা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে মতি, জিনিসডা লইছস?’
‘জ্বি ভাইসাব। লইছি।’
‘কাচাকাচি থাক। আমার তো শত্তুরের অভাব নাই। ক্যাডায় জানে কহন দরকার পড়ে!’ বললেন মাতব্বর, সামনে এগোচ্ছেন টর্চ মেরে মেরে।
‘ঠিক আচে ভাইসাব। আপনি চিন্তা কইরেন না।’ অভয় দিল মতি।
‘মাতব্বর চাচা।’ একটা কণ্ঠ ডেকে উঠল ওপাশের কোন একটা গলি থেকে।
চকিতে সেদিকে টর্চের আলো ফেললেন মাতব্বর, ‘কে? কে ওখানে? ও, হাসান?’
‘জ্বি চাচা। আমি হাসান। যাইতেছিলাম আপনার কাছে।’
‘তয় কি মনে কইরা?’ মাতব্বর হাঁটতে হাঁটতে চলে এলেন হাসানের কাছাকাছি।
‘চাচা, একটা উপকার করন লাগে।’ বললো হাসান।
মাতব্বর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চাপা একটা দুঃখ আছে তার। তিনি চেয়েছিলেন পুতুলনাচের আসরটা বসুক গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মাঠে। বড় মাঠ, অনেক মানুষ আরাম করে বসতে পারবে। তাছাড়া ঘরের দোরে আসর বসলে মানুষের আগ্রহ বেশি থাকবে, আসরটাও জমবে বেশ। কিন্তু কিছু মানুষ তার এই ইচ্ছের গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছিল। করলে অবশ্য করতে পারতেন, কিন্তু মাতব্বর খুব একটা জোর করেননি। করেননি চেয়ারম্যান সাহেবের অনুরোধে। তিনি বলেছিলেন, ‘মাতব্বর সাহেব, শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ? তার চেয়ে খোলা জায়গায় করুন। দেখবেন যে যাওয়ার সে ঠিকই যাবে।’ গ্রামের দু’কলম লেখাপড়া জানা কিছু মানুষ তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল, মুখে চুনকালি মাখাল সারা গ্রামের লোকের সামনে। তাদেরই একজন হাসান, বজ্জাতের বজ্জাত, এখন তার কাছে এসেছে ঠেকায় পড়ে। উপকারের আশায়। এত সাহস পায় কই পোলা? ক্রোধে কাঁপছিলেন মাতব্বর ভিতরে ভিতরে। ইচ্ছে করছিল মতির কাছ থেকে জিনিসটা নিয়ে হাসানের পেটের ভিতরে সেঁধিয়ে দেন এক পলকে, টেনে বের করে আনেন ভিতরের সব নাড়িভুড়ি। কিন্তু মনের কথা রইল মনেই, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন, ‘পুতুলনাচের ওদিকে যাইতেছি। চলো। যাইতে যাইতে হুনি কি উপকার করন লাগব।’
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে মাতব্বরের। কুয়াশায় ঘোলা চাঁদের আলোয় টের পাওয়া সম্ভব নয় সে ঘামের অস্তিত্ব। হাতের চেটোয় ঘাম মুছলেন মাতব্বর, বললেন, ‘হাসান মিয়া, পুতুলনাচ দেকতে গিছিলা কোনদিন?’
‘না, যাই নাই চাচা।’ সত্যিটাই বললো হাসান।
‘এইগুলান হইল চাষা-ভূষা গো বিনোদন। তোমরা শিকখিত মানুষ। তোমরা কি আর যাইবা! তোমরা যাইবা টাউনে। হুনি সেইহানে নাকি ম্যালা কিছু পাওন যায়, টেকা ছিটাইলে। মিঠেখালি গ্রামের অনেকেই যায় সেকানে। সব খবরই আসে কানে। বুজলা?’ মাতব্বর বললেন রসিয়ে রসিয়ে।
ইচ্ছে করছিল মাতব্বরের কথার প্রতিবাদ করতে। কিন্তু করল না। তার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। হাসান তাই চুপ করে রইল। মাতব্বর হাঁটছেন সামনে সামনে। তার পিছনে হাসান। একদম পিছনে মাতব্বরের চামচা মতি। নিজের দরকারী কথাটা পাড়তে যাচ্ছিল হাসান, তখনই মাতব্বর বলতে শুরু করলেন, ‘হাসান মিয়া, হুনছো নি? সুখবর আচে একখান। উপর থেকে পারমিশন লওয়া হইছে, পুতুলনাচ চলব আরও এক সপ্তা।’
এইটা নাকি সুখবর! মনটা বিষাদে ভরে উঠল হাসানের। প্রবৃত্তি হচ্ছিল না লোকটির পিছু পিছু হাঁটতে। তবুও হাঁটতে লাগল। গরজটা যেহেতু তার সে কারণেই। এক সময় বললো, ‘চাচা, আমি আপনার কাছে যাইতেছিলাম…।’
মাতব্বর মাঝপথে থামিয়ে দিলেন, ‘বাবারে, অত উতলা হইলে কি চলে? কইলাম তো, হুনুম তোমার কথা। আগে লও পুতুলনাচ দেহি। আইজকা তুমি হইবা আমার মেহমান। ইসপেসাল মেহমান।’ বলেই হা হা করে হাসলেন মাতব্বর।
হাসানের বুঝতে বাকি রইল না যে সে একটা জালে আটকা পড়েছে। সে জাল দক্ষ হাতে বোনা বড় যত্ন করে, সুতোগুলোও নিয়মিত গাবের কষ দেওয়া। বড় মাছ ধরার জাল, কাঁঠিগুলো ভারী অনেক। সে জাল ছিড়ে বেরোনোর কোন উপায় নেই, নেই বোদের মধ্যে মাথা গুঁজে মেছুয়াকে বোকা বানানোর পথও। মাতব্বরের কণ্ঠে বড় মাছ জালে ঘিরে ফেলার আনন্দ।
প্যাণ্ডেলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই পুতুলনাচদলের ম্যানেজার দৌড়ে এলেন শরীফ মাতব্বরের কাছে, ‘মাতবর সাব, আপনার জন্যি ওয়েট করতিছি।’
মাতব্বর মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘আর দেরি কইরেন না। শুরু কইরা দ্যান। আর আইজকা এট্টা চেয়ার বেশি দ্যান। আমার একজন মেহমান আছে। ইসপেশাল মেহমান।’
মঞ্চের খুব কাছে, পূর্বপার্শ্বে দু’টো চেয়ার দেয়া হলো। তার একটাতে বসলেন মাতব্বর। অপরটিতে হাসান। জানা গেল আজ দেখানো হবে লোককাহিনী ‘কমলার বনবাস’। মঞ্চের সামনের জায়গাটা কানায় কানায় ভর্ত্তি হয়ে গেছে। পুতুলনাচ আরম্ভ হলো। পর্দার সামনে রয়েছে কাঠি দিয়ে তৈরি পুতুলগুলো। নানা রকম পোষাক পরানো। পুতুলের হাত, পা, মাথা, কোমর আটকানো রয়েছে সুতো দিয়ে। সুতার সাহায্যে উপর থেকে পুতুলগুলোকে চালনা বা অভিনয় করানো হচ্ছে। হাসান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল পুতুলনাচ। কিন্তু পাশে বসে মাতব্বর বারবার উশখুশ করছিলেন। এই কাঠির তৈরি পুতুলের নাচ দেখে তার যেন ঠিক মন ভরছিল না।
কিছুক্ষণ বাদে একটা গোল বাঁধল। মঞ্চের ঠিক সামনে কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে চিৎকার শুরু করে দিল। শুধু তাদের চিৎকারের শব্দই যা শোনা গেল, কিন্তু তারা কি বলে চেঁচাচ্ছে সেটার এক বর্ণও উদ্ধার করা গেল না। ততক্ষণে তাদের পিছন থেকে আরও কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়েছে। বোঝা গেল তারাও সমর্থন জানাচ্ছে পূর্ববর্তীদের। হাসান কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। মাতব্বর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে জানতে চাইলেন, ‘কি হইছে? কি হইছে?’
পুতুলনাচদলের ম্যানেজার দৌড়ে এলেন, ‘মাতবর সাব। ওরা কয় এই পুতুলনাচ দ্যাকবি না।’
‘তয় কি দ্যাকব?’ একটু অবাক হওয়ার ভান করলেন মাতব্বর।
‘কমলার নাচ দেকতি চায়। হ্যারা কমলারে চায়।’ বললেন ম্যানেজার।
মাতব্বর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। একটা পুলক ছড়িয়ে পড়ল মঞ্চের সামনে বসা দর্শকদের মধ্যে। পুতুলনাচদলের কেউ একজন কাঠির তৈরি পুতুলগুলো সরিয়ে রাখছে। ‘পুতুল কমলা’র আর বনবাসে যেতে হলো না। এখন নতুন করে মঞ্চ সাজানো হচ্ছে। একটু বাদে ‘রক্ত-মাংসের’ কমলার নাচ আরম্ভ হবে। মাতব্বর দু’হাতের তালু ঘষে অদৃশ্য দড়ি পাকালেন। বোধ হয় শরীরটাকে কিছুটা চাঙ্গা করতে চাইলেন।
শিশির পড়ছে ভালো মতোই, একেবারে শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে। হাসান মাথায় হাত দিয়ে দেখল চুল ভিজে জবজবে। এত রাত অবধি বাইরে থাকার কোন পরিকল্পনা ছিল না তার। তাই প্রস্তুতিও নিয়ে বের হয়নি ঘর থেকে।
আলো কম ছিল। তাই আরও একটা হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হলো। বড় ঢোলে বাড়ি পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে যেন কেঁপে উঠল বুকের মধ্যখানটা। তারপর একে একে আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র বাজতে শুরু করল। সব বাজনার ঐক্যতানে একটা সুর তৈরি হলো। চেনা কোন গানের সুর। ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবন ভরা অঙ্গে’। গান শুরু হওয়ার সাথে সাথে স্টেজে উড়ে এলো কমলা। যেন একটা পরী! শুধু দু’টো ডানাই যা নেই! মাতব্বর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন কমলার দিকে, পুড়তে লাগলেন তার রূপের আগুনে। কি যেন একটা আছে তার মধ্যে! বয়সে কচি এখনও। মাঝারির দিকে গড়ন। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। গোল মুখ। লম্বা নাক। ভরাট বুক। ভারী পিছনটা। গানের তালে তার শরীর দুলছে। যেমন ভাবে বৈশাখী ঝড়ে দোলে বাতাবি লেবুর গাছটা। ঢোলের বাড়িতে ঢেউ উঠছে তার বক্ষনদীতে। ভুবন-মোহিনী হাসি যেন আফিমের পুরিয়া, ডাকছে সবাইকে ঘুমের দেশে, ঘুম পড়াবে বলে। আবার মায়া জড়ানো চোখজোড়া ক্ষণে ক্ষণে হয়ে উঠছে শিকারির বল্লম, সম্মোহনী ইশারায় ঘুম হারাম করে দিচ্ছে সারাদিন মাঠে খেটে ক্লান্ত মানুষগুলোর। উল্লাসে চিৎকার করছে দর্শকরা, ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে তারা মঞ্চের গোড়ায়- যেভাবে নদীর ঢেউয়েরা মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ে তীরের কোলে।
পর পর কয়েকটা গান বাজল। কমলা’ই নাচল সবগুলো গানের সাথে। হাসানের বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। কিন্তু উঠে যাওয়ারও উপায় নেই। মাতব্বর সাহেবের ইচ্ছে-কারাগারে সে এখন বন্দী।
শরীফ মাতব্বর দু’চোখ ভরে দেখছেন কমলার সৌন্দর্য। মেয়েছেলে কিভাবে এত সুন্দর হয়! কিভাবেই বা হয় এমন উদ্ভিন্ন যৌবনের আধার! কমলা স্টেজে ওঠার পর থেকে শীত যেন পালিয়েছে। বুকের ভিতরটাতে মৃদু ধুকধুকানি টের পাচ্ছেন তিনি। কয়েকবার হাত চলে গেছে তলপেটের দিকে। ওদিকটা উষ্ণ ভীষণ, তা’ দিতে বসা মুরগির তলের মতো। অবশ্য একটা ব্যাপারে আজ একটু নাখোশ তিনি। কমলা মেয়েটার চোখের গতিপথ আজ যেন একটু পাল্টেছে। গত কয়েকদিন মেয়েটা নাচের ফাঁকে বারংবার তার দিকে তাকিয়েছে। অথচ আজ তার দৃষ্টিসীমায় যেন শুধুই হাসান। আজ কি হলো মেয়েটার! তারই ভুল হয়েছে। এমন সুদর্শন চওড়া সিনার যুবককে কিছুতেই তার সাথে এক কাতারে বসানো ঠিক হয়নি।
নাচের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এখন নাচবে অন্য মেয়েটা। শেষে আর একবার কমলা আসতে পারে স্টেজে। তবে নিশ্চিত নয়। নির্ভর করবে তার মন-মেজাজের উপর। সেরা নাচিয়ে বলে কথা! মাতব্বর ইশারায় ডাকলেন হাসানকে, কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘হাসান মিয়া, তুমি বরঞ্চ আজ যাও। কাল তোমার কথা হুনুমনে।’
‘কিন্তু চাচা, আমার দরকারটা...।’ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল হাসান। তাকে থামিয়ে দিলেন মাতব্বর, ‘ঠিক আচে বাবা, বুজলাম তো, জরুরী কিচু। হুনুমনে কাইল। সক্কাল সক্কাল আইসা পইড়ো।’
‘ঠিক আছে, চাচা।’ বললো হাসান, উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু মাতব্বরের মতিগতি ঠিক ভালো মনে হচ্ছিল না। তাই কিছুদূর গিয়ে থামল একটা জায়গায়। এখানে হ্যাজাকের আলো এসে পৌঁছাচ্ছে না। তাই জায়গাটা ফিকে আঁধারে মোড়া। মাতব্বরকে দেখতে পাচ্ছে সে এখান থেকে। কিন্তু মাতব্বর তাকে দেখতে পাচ্ছে না- এটা সে মোটামুটি নিশ্চিত।
কিছুক্ষণবাদে মাতব্বর উঠে দাঁড়ালেন। ইশারায় মতিকে ডাকলেন কাছে। ওর কাছ থেকে কিছু একটা নিয়ে চোখের পলকে কোমরে গুঁজলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। সামান্য কিছুটা এগোনোর পর গতিপথ পরিবর্তন করলেন, ঘুরানো পথে হাঁটতে শুরু করলেন অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। একটু বাদে বোঝা গেল তিনি চলেছেন ঐ অস্থায়ী ঘর দু’টোর দিকে, যেখানে পুতুলনাচদলের সদস্যরা থাকে, শো এর ফাঁকে ফাঁকে সাজ-পোষাক বদলায়।
ওদিকে গান বাজছে। স্টেজে গানের তালে তালে নাচছে অন্য মেয়েটা। এক সময় মাতব্বর পৌঁছে গেলেন বিশেষ ঘরটার কাছে। দরজায় দাঁড়ানো পুতুলনাচদলের দলপতি মাতব্বর সাহেবকে দেখে চমকে উঠলেন। ‘কমলা কোন্ ঘরে?’ একটু কড়া গলায় জানতে চাইলেন মাতব্বর।
‘জ্বি, জ্বি ঐ ঘরে।’ ইশারায় দেখাল দলপতি। তাকে পিছনে ফেলে একটু এগোলেন মাতব্বর। দলপতি চিঁ চিঁ করে উঠল, ‘ওদিকে যাবেন না এখন। যাওয়া মানা।’
‘মানা?’ হাসলেন মাতব্বর, সাদা দাঁত চকচক করে উঠল। এক ঝটকায় দরজা খুললেন। কমলা দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের ঠিক মাঝখানটায়। দরজা খোলার শব্দে ঘুরে দাড়াল সে, ভুত দেখার মতো চমকে ওঠা চোখ দিয়ে দেখল মাতব্বরকে। ‘আপনি?’ গলার স্বরটা যেন কমলার নয়, একটা হাঁসের।
একটু তাড়াহুড়ো করে বসলেন মাতব্বর। হাত বাড়িয়ে কমলাকে কাছে টানলেন, জড়িয়ে ধরতে চাইলেন বুকের সাথে, ‘বলো কমলা, তুমি আমায় বিয়ে করবে? আমি তোমায় রাজরাণী করে রাখব। তখন তোমায় আর এদেশ ওদেশ ঘুরতে হবে না। বলো কমলা, তুমি আমার হবে? শুধু আমার!’
কমলা কোন কথা বললো না। ছাড়িয়ে নিতে চাইল মাতব্বরের বাহুডোর থেকে। দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলল কিছুক্ষণ। এর মধ্যে এক সময় খসে পড়ল কমলার পরচুলা। তার বুকের কিছু অংশও অনাবৃত হলো। সেদিকে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ালেন মাতব্বর। এ কি! এ তো শুধুই সমতল ভূমি! যেন কচি দূর্বার ক্ষেত! মাথার দিকে তাকিয়ে দেখলেন খুব ছোট করে কাটা চুল। তবে কি কমলা মেয়ে নয়!
দলপতি ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়েছে। বুঝে গেছে গোপন করার পথ বন্ধ, তিন তাড়াতাড়ি হাতজোড় করল তাই, ‘মাতবর সাব, আমারে মাফ কইরা দেন। কি করুম কন্? কোন মাইয়া অহন আর দলে আসবার চায় না। যদিও আসবার চায়, ম্যালা টেকা চায়। অতটাকা কোন পার্টি দিবার চায় না। তাই আমার পোলাডারে কমলা সাজাইয়া দ্যাশে দ্যাশে ঘুরি। পুতুলনাচ দেহাই।' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল দলপতি।
মাতব্বরের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। কলিজাটা যেন পুড়ে যাচ্ছিল। না পাওয়ার যন্ত্রণায়। প্রতারিত হওয়ার ক্ষোভে। পরাজয়ের গ্লানিতে।
‘কোন মাফ নাই। তগো কোন মাফ নাই।’ শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন মাতব্বর। তার ডান হাত চলে গেল কোমরে, হ্যাচকা টানে বের করে আনল একটা ছোরা। ধারালো ছোরাখানি প্রতিবিম্বিত হলো মাতব্বরের চোখের মণিতে। ‘কোন মাফ নাই।’ বিড়বিড় করে বললেন তিনি আরও কয়েকবার। ওদিকে একটা গান শেষ হয়েছে। দর্শকের হাততালি শোনা গেল। সেইসাথে ভেসে এলো বিপুল হুল্লোড়ের শব্দ। মাতব্বরের উচ্চারিত শব্দগুলো চাপা পড়ে গেল সে শব্দরাশির নিচে।
মাঘের রহস্যময়ী চাঁদের আলোয় একটা যুবককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল অস্থায়ী ঘরদু’টোর দিকে। শিশির জড়িয়ে ধরছে তার পা দু’টো।

Comments

Popular posts from this blog

Mimi Chakraborty Biography

ঠিকানার জন্মকথা